মেটাবলিজম, শরীরের গড়ন এবং ব্যায়াম
শরীরবিজ্ঞানী ও ব্যায়াম বিশেষজ্ঞরা মেটাবলিজম কথাটা প্রায়ই ব্যবহার করেন; আমরাও শুনি। কিন্তু মেটাবলিজম মানে কি, আর শরীরের গড়ন এবং ব্যায়াম করার সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কি এ নিয়ে যথেষ্ট স্পষ্ট ধারণা আমাদের অনেকেরই নেই।
ডাক্তারী কচকচির মধ্যে না গিয়ে দেখা যাক কথাটা কি অর্থে ব্যবহার করা হয়। এক কথায়, আমাদের শরীরের যন্ত্রগুলিকে চালু রাখতে প্রতিদিন যে প্রক্রিয়ার সাহায্যে শক্তি তৈরি এবং ব্যয় হয় তাই হল মেটাবলিজম। আর শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন, তাই হল আমাদের মেটাবলিজম এর হার। চলতি কথায় এটাকেই সাধারণভাবে মেটাবলিজম বলা হয়।
কিন্তু দেখা যায় যে এক এক ধরণের শরীরের মেটাবলিজমের পরিমাণ এক এক রকম। এই ফারাক অনেক কারণেই হতে পারে। একটি প্রধান কারণ হল আমাদের এক এক জনের শরীরের ধাঁচের তফাৎ। যাদের শরীরে পেশির পরিমাণ বেশি আর ফ্যাট বা মেদ কম, দেখা যায় মেদবহুল মোটা গড়নের ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের মেটাবলিজম অনেক বেশি। কারণ, ফ্যাটের চেয়ে পেশিগুলিকে সচল রাখতে অনেক বেশি শক্তি ব্যয় হয়।
আবার উলটো দিক থেকে একথা বলা যায় যে যদি আপনার শরীরের মেটাবলিজম কম হয় তাহলে আপনার শরীরে মেদ বা চর্বি জমতে থাকবে। আমাদের শরীর চালু রাখতে যে শক্তি দরকার তা আমরা জোগাড় করি আমাদের প্রতিদিনের খাবার থেকে। আমরা আমাদের খাবারের মাধ্যমে যে পরিমাণ শক্তি পেলাম, যদি আমাদের শরীরযন্ত্রকে চালু রাখতে তার চেয়ে কম শক্তি খরচ হয়, তাহলে এই বাড়তি শক্তি মেদ বা চর্বি হয়ে শরীরের ভেতরে বাইরে নানা জায়গায় জমতে থাকে। আর যদি যতটা পেলাম সারাদিনে তার চেয়ে বেশি শক্তি খরচ হয় তাহলে শরীরের ভিতরে জমে থাকা মেদ ঝরে যেতে থাকে। কারণ, শরীর ধীরে ধীরে জমে থাকা বাড়তি মেদ বা ফ্যাট থেকে এই শক্তি জোগাড় করে নেয়।
এই প্রসঙ্গেই দেখা যাক বি.এম. আর(BMR- Basal Metabolic Rate) বলতে কি বোঝায়। আমরা সারাদিন যদি বিশ্রামে থাকি, তাহলে আমাদের শরীর টিকিয়ে রাখতে একটা ন্যূনতম শক্তির প্রয়োজন। যেমন, হৃদযন্ত্র বা হার্ট চালু রাখা, নিশ্বাস- প্রশ্বাস থেকে খাবার হজম করা, রক্ত চলাচল সবকিছু। এই পরিমাণই হল আমাদের বি.এম.আর। আর যখন আমরা ব্যায়াম বা যে কোন খাটাখাটুনির কাজ করি, তখন তা করার জন্য লাগে বাড়তি শক্তি।
নানা ধরণের ব্যায়াম বা শারীরিক কসরতের মাধ্যমে স্থায়ী ও অস্থায়ী দুভাবেই আমরা মেটাবলিজম বাড়াতে পারি এবং শরীরে বাড়তি মেদ জমার হাত থেকে বাঁচতে বা বাড়তি মেদ ঝরাতে পারি। কিভাবে এবং কোন ধরণের বায়ামের ফলে কিভাবে এটা করা সম্ভব সেটাই ফিটনেস ও শরীর বিশেষজ্ঞদের আলোচনা ও গবেষণার বিষয়।
দৌড়ানো, জগিং, সাইক্লিং, সাঁতার জাতীয় এ্যরোবিক ব্যায়াম অর্থাৎ যে সব ব্যায়ামে হৃদযন্ত্রের উপর চাপ পড়ে ও অনেক বেশি পরিমাণ অক্সিজেন লাগে, ব্যায়াম চলাকালীন সাময়িকভাবে অনেক বেশি শক্তির ব্যয় হয়, ফলে মেটাবলিজম অনেক বেড়ে যায়। দেখা গেছে মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার এই ব্যায়াম শেষ হওয়ার অনেক পরেও মেটাবলিজমের হার অনেক বেশী থাকে। ফলে মেটাবলিজম বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি মেদ ঝরানো বা তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই ব্যায়ামগুলি বেশ কাজের।
অন্যদিকে ওয়েট ট্রেনিং অর্থাৎ ওজন নিয়ে ব্যায়াম চলার সময়ে মেটাবলিজম খুব বেশি না বাড়লেও স্থায়ীভাবে মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে। এই ব্যায়ামগুলির ফলে পেশীগুলি আরও শক্তিশালী হয়, পেশীর ক্ষয় আটকায় এবং পেশির পরিমাণ বাড়তে সাহায্য করে। ফলে মেটাবলিজম বাড়ে স্থায়ীভাবে।
ব্যায়াম বিশেষজ্ঞরা তাই মেদ নিয়ন্ত্রণ করে একটা সুগঠিত শরীর পাওয়ার জন্য এই দুই ধরণের ব্যায়ামই একটা রুটিন মেনে করবার পরামর্শ দিয়েছেন। এর সঙ্গে দরকার একটা সুষম খাদ্যতালিকা। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত এবং মিষ্টিজাতীয় খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা দরকার। খাদ্যতালিকায় নিয়মিতভাবে প্রোটিন, ফল ও সব্জিজাতীয় খাবার থাকাটা জরুরী।
অনিয়মিত খাওয়া, অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকা, ওজন কমানোর জন্য প্রায় উপোষ করার জন্যেও মেটাবলিজম কমে এবং শরীরে মেদ জমে। একবারে অনেকটা না খেয়ে বেশ কয়েকবারে অল্প করে খেলে মেটাবলিজম বাড়ে। না খেয়ে বা ভীষণভাবে কম খেলে শরীর খারাপ তো হবেই, উলটে মেদ ঝরার বদলে পেশির ক্ষয় হবে অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত।
অনিয়মিত ঘুম, মানসিক চাপ ও অবসাদ, বয়স বেড়ে যাওয়া এবং থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের নিস্ক্রিয়তা এবং অন্যান্য হরমোনজাত অসুবিধার জন্যেও মেটাবলিজম কমে এবং মেদ জমে। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক ব্যায়াম করতে হবে। তাতে সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা এবং কমানো সম্ভব। বংশগত কারণেও আপনার শরীরের মেটাবলিজম কম বা বেশি হতে পারে।
সবশেষে একটা কথা। নানা কারণে সবার পক্ষে দারুণ পেশিবহুল শরীর বা আদর্শ একটা শরীর পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু আপনার শরীরের গড়ন ও জীবনযাত্রার ধরণের কথা মাথায় রেখে যদি ঠিকমত ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করেন, তাহলে আপনার জন্য সেরা আকর্ষণীয় শরীর আপনি পেতেই পারেন। তবে তার জন্য আপনাকে সবার আগে যেতে হবে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে, যিনি আপনার শরীরের গড়ন মাথায় রেখে আপনার জন্যে একটা রুটিন করে দেবেন। না হলে কিন্তু ব্যায়ামে লাভের চেয়ে ক্ষতি হতে পারে বেশি। আর যদি কোন বড় ডাক্তারী সমস্যা থাকে তবে ব্যায়ামের আগেই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
বিভিন্ন ধরণের ব্যায়ামের মাধ্যমে কিভাবে মেটাবলিজম বাড়িয়ে মেদ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা পরে জানানোর ইচ্ছে রইল।